ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া: এক নতুন প্রেক্ষাপট

পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ৭ থেকে ১০ মে—এই চারদিনে দক্ষিণ এশিয়া দেখেছে এক টানটান উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধের পূর্বাভাস, যেন এক ‘সংক্ষিপ্ত ট্রেলার’। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মুখোমুখি অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। তবে এই দ্বন্দ্ব শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ছিল না—মূলত এটি ছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ছায়াযুদ্ধের প্রতিফলন। এমনটাই উল্লেখ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজ

বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের ব্যবহৃত অধিকাংশ যুদ্ধাস্ত্রের উৎস চীন। আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক ইতোমধ্যেই বহুল আলোচিত। ফলে পাকিস্তানের হয়ে চীনের সরাসরি সমর্থন এবং ভারতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান—এই দ্বন্দ্বকে একটি গ্লোবাল প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়েছে।

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো সদানন্দ ধুমে বলেন, “চীনের জন্য এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। পাকিস্তান তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র, এবং বেইজিং চায় না তাদের কোনো মিত্রকে অপমানিত হতে দেখতে।” তিনি যোগ করেন, “চীন-পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত—এই দুটি ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর কারণে যেকোনো সংঘর্ষ দ্রুতই বড় শক্তিগুলোর ‘প্রক্সি যুদ্ধ’-এ পরিণত হতে পারে।”

নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ম্যাক্স আব্রাহামস ফক্স নিউজকে বলেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা আসলে মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার এক নতুন রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।” তাঁর মতে, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানকে চীন সমর্থন করার মধ্য দিয়ে এই সংঘাত প্রক্সি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

ইগাল কারমন, মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এবং ইসরায়েল সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মনে করেন এই যুদ্ধ শুধু কাশ্মীরের নয়, বরং পুরো অঞ্চলকেই অস্থির করতে পারে। তিনি বলেন, “যদি সংঘাত বিস্তৃত হয়, পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে, যার প্রভাব আফগানিস্তান, ইরান এমনকি চীনেও পড়বে। বিশেষত বেলুচিস্তানের সম্ভাব্য স্বাধীনতা ও গোয়াদর বন্দরে চীনা বিনিয়োগ চরম ঝুঁকিতে পড়বে।”

চীনের সামরিক আধুনিকীকরণ ইতোমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে তারা সীমান্ত, সমুদ্র ও মহাকাশ থেকে ভারতের পদক্ষেপ নজরে রাখতে সক্ষম। সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নিল বলেন, “এই সংঘাত চীনের জন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সরাসরি প্রতিপক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে কার্যকর সক্ষমতা যাচাইয়ের এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ।”

ফক্স নিউজের তথ্য অনুযায়ী, চীনের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান পাকিস্তান ব্যবহার করে ভারতের অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করা হয়, যার একটি ছিল ফরাসি প্রযুক্তির রাফাল। যদিও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুদ্ধবিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জে-১০ ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

আকাশযুদ্ধ বিশ্বের সামরিক বাহিনীর জন্য একটি বিরল অভিজ্ঞতা, যেখানে তারা নিজেদের প্রযুক্তি ও প্রস্তুতির কার্যকারিতা পরখ করতে পারে। ভারত ও চীন দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী। হিমালয় অঞ্চলে ৩৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ঘিরে ১৯৫০’র দশক থেকেই রয়েছে উত্তেজনা, যা বারবার সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।


উপসংহার:

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কেবল আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়। এটি এখন একটি ভূরাজনৈতিক শক্তির খেলা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলছে। একদিকে পারমাণবিক বিপদের শঙ্কা, অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর অনিশ্চয়তা—এই দুইয়ের মধ্যে বিশ্ব এখন নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ঘটনার।