“আমরা শুধু বাঁচতে চাই”—গাজার শিশুদের নিঃশব্দ আর্তি
গাজা শহরের পশ্চিমাংশে তেল আল-হাওয়া পাড়ার ধ্বংসস্তূপের নিচে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো পড়ে আছে—ধুলোয় গড়িয়ে, বুলডোজারের চিহ্নে পিষ্ট। সেই ধ্বংসের মাঝেই, একটি ছেঁড়া তাঁবুর নিচে বসে আছে ১৪ বছরের কামাল মাহদি। কুঁজো হয়ে বসা ক্ষীণদেহ এই কিশোর শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে ধ্বংসস্তূপের দিকে—যেন হারানো শৈশব খুঁজে ফিরছে।
“যুদ্ধের আগে জীবনটা ছিল খুব সাধারণ,” বলে কামাল। “ভোরে উঠতাম, ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যেতাম। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। দাদার কাছে বসে শুনতাম ১৯৪৮ সালের কথা, যখন আমাদের লোকজনকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।”
তার গলায় কান্না ধরে আসে। “আগে ভাবতাম, ওগুলো কেবল গল্প। এখন আমি বুঝি—ঘর হারানোর যন্ত্রণা কেমন, কিভাবে যা আছে তা নিয়ে দৌড়াতে হয়, কিভাবে বোমার শব্দে ঘুমাতে হয়, আর ধুলোর মধ্যেই জেগে উঠতে হয়।”
২০২৩ সালের অক্টোবরে এক ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস হয় তার পাড়া। সেই আঘাতে শুধু ঘর নয়, ধ্বংস হয়ে যায় তার ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনাও।
“আমরা বারবার পালিয়েছি,” বলল মাহদি। “ফেলে এসেছি অ্যালবাম, খেলনা, স্কুলের খাতা—এমনকি দাদার কবরটাও। বিদায়ও জানাতে পারিনি।”
তার পাশেই বসে ১২ বছরের চাচাতো বোন ক্যামেলিয়া, প্লাস্টিকের চাটাইয়ে গুটিসুটি মেরে, আঁকড়ে আছে একটি পুরোনো স্কুলব্যাগ।
“আমি স্কুল ভালোবাসতাম,” জানায় ক্যামেলিয়া। “নতুন বইয়ের গন্ধ, ইউনিফর্ম পরে গর্বে বুক ফোলা—সবই আমার প্রিয় ছিল। আমার শিক্ষক বলতেন, আমার গলার স্বর সুন্দর। স্বপ্ন ছিল একদিন শিক্ষক হব।”
ক্যামেলিয়া চোখ মুছে তাকায় ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশের দিকে। “এখন তো বাতাসের শব্দেও ভয় পাই। মনে হয় বিমান আসছে। কানে হাত দিয়ে বসে থাকি, কখন বিস্ফোরণ হবে। আগে কুতকুত আর লুকোচুরি খেলতাম, এখন সত্যিই লুকাই—কিন্তু কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই।”
কামাল পাশে বসে কাঁধে রাখে সান্ত্বনার হাত। “আমরা তো শিশু। কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন আমরা নিজের ভেতর থেকে হারিয়ে ফেলছি কিছু একটা।”
শৈশব মানে এখন আতঙ্ক আর আশ্রয়কেন্দ্র
মাহদির শেষ কথা যেন গাজার সব শিশুর মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায়: “আমাদের চাওয়া খুব বেশি নয়—শুধু বাঁচতে চাই।”
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬,৫০০ শিশু নিহত হয়েছে। হাজার হাজার শিশু পঙ্গু, দগ্ধ, বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
আল-নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে নয় বছর বয়সি ঈসা আহমেদ নিজের ধ্বংস হওয়া বাড়ির ওপর তৈরি এক তাঁবুতে বাস করছে। কয়েক মাস আগের বিমান হামলায় সে দুই হাত হারিয়েছে।
তার মা সারা বলেন, “সে দেয়ালে পাখি আর সাগরের ছবি আঁকত। এখন সে নিজের চোখের জলও মুছতে পারে না।”
ঈসা জানায়, “স্বপ্নে দেখি, আমি হাত ফিরে পেয়েছি, দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরছি। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সব মনে পড়ে যায়।”
একই হামলায় সারা হারিয়েছেন তার স্বামীকেও। এখন তিনি একাই সন্তানদের লালন করছেন। “সে জিজ্ঞেস করে, হাত কি আবার গজাবে? আমি কী বলব বুঝি না, শুধু বলি—তুমি সাহসী।”
শিশুদের পিঠে যুদ্ধের ভার
১০ বছরের লুজাইন শেহাদা দেইর আল-বালাহর একটি শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে পানি আনার জন্য। সে জানায়, “মাটিতে ঘুমাই। পিঠে ব্যথা হয়, পায়ে ঠাণ্ডা লাগে। আমার বিছানা আর স্কুলকে খুব মিস করি।”
ফিলিস্তিনি শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ বারহামের ভাষ্য অনুযায়ী, গাজার ৯৫ শতাংশের বেশি স্কুল বন্ধ। বিদ্যুৎহীনতা, নিরাপত্তার অভাব এবং অব্যাহত বোমাবর্ষণের কারণে বিকল্প শিক্ষাও সম্ভব হচ্ছে না।
টিকতে না পারা শৈশব
গাজাভিত্তিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রাওয়ান গায়াদার বলেন, “এই শিশুরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে, PTSD-তে ভুগছে। কেউ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ রাতে ঘুমাতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে। কেউ কেউ নিজের নাম হাতে লিখে রাখছে—যদি মরেও যায়, যেন পরিচয়টা থাকে।”
শিশুদের প্রয়োজন এখন শুধু খাবার বা আশ্রয় নয়—চাওয়া খুব সহজ: নিরাপত্তা, শিক্ষা, খেলা এবং স্বপ্ন দেখার অধিকার। অথচ সেই ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।