লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠক: জাতীয় ঐকমত্যের নতুন দিগন্ত

লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো বহু প্রতীক্ষিত বৈঠক—অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ডি-ফ্যাক্টো নেতা তারেক রহমানের মধ্যে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বৈঠক ঘিরে ছিল চরম উত্তেজনা ও কৌতূহল। কারণ, একদিকে সরকার ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চেয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময়েই আসে এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপের খবর।

বৈঠক ঘিরে অনেক চক্রান্ত, চেষ্টা-তদবির চললেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। ১৩ জুনের এই আলোচনায় সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হলো—ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের টাইমফ্রেম নিয়ে যৌক্তিক সমঝোতা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রমজানের আগেই নির্বাচন সম্ভব। বিএনপিও ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন’ দাবি থেকে সরে এসেছে। এই পারস্পরিক ছাড়ে রাজনীতিতে এসেছে স্বস্তির হাওয়া—যেটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ব্যক্তিত্ব ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন নেতা এবং তারেক রহমানের মতো দীর্ঘ লড়াই করে তৈরি হওয়া নেতার এই ঐকমত্য নিঃসন্দেহে একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি। ইউনূস পেতে পারেন বিএনপির সমর্থন, যা মৌলিক সংস্কার ও ভবিষ্যতের ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছে নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত সময়সীমা।

এই বৈঠকের আগে বিএনপির আরও দুটি দাবি ছিল—ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে বসানো এবং তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ। লন্ডনের আলোচনায় সেগুলোর স্থান হয়েছিল কি না তা স্পষ্ট নয়, তবে বড় লক্ষ্যের সামনে এসব দাবি এখন গুরুত্ব হারাতে বসেছে।

এই রাজনৈতিক সমঝোতায় দুই নেতার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ড. ইউনূস একাধিকবার আগের সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর তারেক রহমান ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী দমন-পীড়ন এবং নির্বাসনের মধ্য দিয়েও দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিপক্বতা আজকের অর্জনের ভিত্তি।

জাতীয় স্বার্থে এই ঐক্যমত্যের পথে সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ৭৯ বছর বয়সেও তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে দুই নেতাকে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি হয়ে উঠেছেন এক ‘রাজনৈতিক সেতু’, যিনি তার দলের ভবিষ্যৎ ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থ একসূত্রে গাঁথতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় ঐকমত্যের উদাহরণ কম। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ বিভাজিত হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান বহু দলীয় গণতন্ত্র চালু করে ঐক্যের পথে নতুন অধ্যায় শুরু করেন। সেই ধারারই আধুনিক রূপ যেন এই বৈঠক।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এখন একটি বাস্তববাদী কৌশলের পথে হেঁটেছে। সহিংসতা এড়িয়ে, সংলাপের মাধ্যমে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটানোর লক্ষ্যে তারা এগোচ্ছে। যদি তারা আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়, তবে অধ্যাপক ইউনূসের অভিজ্ঞতা এবং বেগম জিয়ার দিকনির্দেশনা কাজে লাগিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও জাতীয় ঐকমত্য-ভিত্তিক সরকার গঠন সম্ভব হতে পারে।

লন্ডনের এই বৈঠক প্রমাণ করল—বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারেক রহমানকে উপেক্ষা করে কিছুই লেখা যাবে না। এই ঐকমত্য নতুন এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করল, যা দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত হয়ে উঠতে পারে।